আরও ৫ জনের করোনা শনাক্ত

গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি। এ পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৪৪৬ জনের।
এদিন নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন পাঁচজন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৩৮ হাজার ২৫০ জন।

মঙ্গলবার (২ মে) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো করোনা বিষয়ক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, ঢাকা সিটিসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও বাড়িতে উপসর্গ বিহীন রোগীসহ গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আটজন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ২০ লাখ পাঁচ হাজার ৬৭২ জন। সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮৮৫টি ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৩৯১টি এবং মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৯০টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে এক কোটি ৫৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৭৪টি।

গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার এক দশমিক ২৮ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯৮ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪৪ শতাংশ।

এতে আরও জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় তিনজন আইসোলেশনে এসেছেন এবং আইসোলেশন থেকে তিনজন ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ পর্যন্ত মোট আইসোলেশনে এসেছেন চার লাখ ৫২ হাজার ২৯২ জন। আইসোলেশন থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন চার লাখ ২৩ হাজার ৯৮ জন। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ২৯ হাজার ১৯৪ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।

ফের করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই মাস ধরে কমলেও ফের তা বাড়ছে। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আইসিইউতে রোগী বেড়েছে। ভিড় বাড়ছে অন্যান্য হাসপাতালেও। টিকা নেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণের হার আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সামনে ঈদ আসছে। ওই সময় দেশে করোনাভাইরাসের কাছাকাছি গোত্রের ভাইরাস ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুম শুরু হবে। তাছাড়া দেশে গরম পড়তে শুরু করেছে। এই সময়ে যদি সচেতনতা বাড়ানো না যায়, তবে ফের সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। কাজেই সারা দেশের মানুষকে মাস্ক পরতে হবে, ঘনঘন হাত ধুতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলতে হবে। নইলে সামনে বড় বিপদ বলে তারা সাবধান করেছেন। এ পরিস্থিতিতে ঈদের ছুটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না, সেই বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

করোনা সংক্রমণের এক বছরের মাথায় বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক যুগান্তরকে বলেন, আমরা করোনা সংক্রমণের এক বছর পার করছি। প্রথম থেকেই করোনা নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমে এসেছে। টিকা নেওয়ার পর মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি শৈথিল্য দেখা দিয়েছে। তারা বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে বেড়াতে যাচ্ছেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করছেন; কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এতে আবার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়তে শুরু করেছে। জাহিদ মালেক বলেন, টিকাদান মানে এই নয় যে দেশ করোনামুক্ত হয়ে গেছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দেশের মানুষকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। বিশেষ করে মাস্ক বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে।

তিনি বলেন প্রথম থেকেই হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো, ডাক্তার-নার্সদের প্রশিক্ষাণ, আইসিইউ শয্যা বাড়ানো, ৯০টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম স্থাপন, রোগীদের সুরক্ষায় পালস অক্সিমিটার নিশ্চিত করা, হাইফ্লো নেজাল ক্যানোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোভিড নিয়ন্ত্রণে সব প্রয়োজনীয়তা মেটাতে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংক্রমণ কমাতে আমরা ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ কার্যকর করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী নিজেই আমাদের এই উদ্যোগে স্বাগত জানিয়েছেন। এভাবে বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক মহামারি প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। আমরা সংক্রমণের হার ৩-এর নিচে এবং মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হই। এরপর মহামারি নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে দ্রুত টিকার ব্যবস্থা করলেন। তার প্রচেষ্টায় আমরা অনেক দেশের আগেই টিকাদান শুরু করেছি। যেখানে ভারতে ৬০ বছরের বেশি বয়সিদের টিকা দিচ্ছে, সেখানে আমরা ৪০ বছরে নামিয়ে এনেছি।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এক বছর আজ। ২০২০ সালের এই দিনে (৮ মার্চ) সরকারের পক্ষ থেকে দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনা সংক্রমণের বিষয়টি জানানো হয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত দেশে সাড়ে ৫ লাখ মানুষ সংক্রমণের শিকার হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষের। গত মাসে টিকাদান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৭ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন।

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অচিরেই সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ টিকার সুবিধা পেতে আরও অন্তত এক বছর লাগবে। তাছাড়া ঈদের ছুটির সময় আমাদের দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুম শুরু হবে। পাশাপাশি ঈদকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের যাতায়াত বাড়বে। সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নতুন করে করোনার সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না। তিনি বলেন, গত ঈদের পরই সংক্রমণের হার পিকে উঠেছিল। সেসময় লকডাউন শিথিল হয়ে গিয়েছিল। এতে মহাবিপর্যয় ঘটতে পারত। সেটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

তিনি বলেন, দেশে গত বছরের ৮ মার্চ করোনার প্রথম সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর আমরা দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম। তারপরেই সারা দেশে লকডাউন কার্যকর করা হয়। ফলে মহামারি ধীরগতি পেয়েছিল। এতে আমরা আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে করোনা নিয়ন্ত্রণে এবং আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সম্পর্কে জেনেছি। ফলে মহামারি নিয়ন্ত্রণ বা সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়েছিল। তাই এখন আসন্ন গরম, ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুম ইতাদি বিষয় মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এসএম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, টিকা নিই আর না নিই, স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, এটা উদ্বেগজনক। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, দেশে করোনা মহামারির এক বছর হওয়ার আগেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। কিন্তু অসচেতনতার কারণে আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী বাড়ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী বাড়ছে। এমনকি যারা বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে গিয়েছে, তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ একদল মানুষ আনন্দভ্রমণে বেরিয়ে বিপদ ডেকে আনছে। তিনি বলেন, এসব বিষয় মাথায় রেখে ঈদের ছুটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আমাজনে পাওয়া করোনার ধরন তিনগুণ বেশি সংক্রামক

ব্রাজিলের আমাজনে পাওয়া করোনাভাইরাসের একটি ধরন তিনগুণ বেশি সংক্রামক হতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলছে– এ ধরনের বিরুদ্ধে টিকা কার্যকর।

বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী এডুয়ের্ডো পাজুয়েল্লো এ কথা বলেছেন। তবে নিজের দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি তিনি।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সঙ্গে জঙ্গলের শহর ম্যানুসে করোনার নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়ছে।

এতে চাপের মধ্যে থাকা এডুয়ের্ডো পার্লামেন্টকে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছেন যে, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে সংক্রমণ বৃদ্ধি অপ্রত্যাশিত হলেও তা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

সিনেটের শুনানিতে তিনি বলেন, আগামী জুন নাগাদ জনসংখ্যার মধ্যে যারা সক্ষম, তাদের অর্ধেককে টিকা দেওয়া হবে। আর বছর শেষ হওয়ার আগে বাকিদেরও প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

কিন্তু অর্ধেক জনসংখ্যার জন্য করোনার টিকা পাওয়ার নিশ্চয়তা না থাকলেও তিনি এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।

সপ্তাহ তিনেক আগে চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক ও ব্রিটেনের অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান কার্যক্রম শুরু করেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি। কিন্তু ম্যানুসে পাওয়া নতুন ধরনের প্রতিরোধে টিকা কতটা কার্যকর; তা ব্যাখ্যা করতে পারেননি এডুয়ের্ডো পাজুয়েল্লো।

তিনি বলেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। বিশ্লেষণ থেকে আমরা পরিষ্কার বার্তা পেয়েছি, করোনার ম্যানুসের ধরনের বিরুদ্ধেও টিকা কার্যকর।

অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের পথে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী, মৃত্যু, নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার—সবই বেশ কিছুদিন ধরে নিম্নমুখী। সে সঙ্গে সারা দেশে শুরু হয়েছে টিকাদান কার্যক্রম। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দৃশ্যত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পথে থাকলেও বিপদ কেটে গেছে, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। কারণ, এখনো ট্রান্সমিশন (সংক্রমণ ছড়ানো) চলছে।

ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনসহ ইউরোপের অনেক দেশে পরিস্থিতি দু–তিন মাস নিয়ন্ত্রণে থাকার পর সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। তখন সংক্রমণ আরও বেশি ছড়িয়েছে।

দেশেও যেকোনো সময় আবার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য তাঁদের পরামর্শ হচ্ছে, নিবিড় নজরদারি বহাল রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করা।

একটি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি না, তা বুঝতে কিছু নির্দেশক ঠিক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছে, সংক্রমণের সর্বশেষ চূড়ান্ত পর্যায় (পিক) থেকে টানা তিন সপ্তাহে যদি রোগী ও সন্দেহভাজন (উপসর্গ রয়েছে) অন্তত ৫০ শতাংশ কমে। অন্তত ৮০ শতাংশ সংক্রমণ যদি নির্দিষ্ট ক্লাস্টারে (একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কাছাকাছি থাকা অনেকের মধ্যে সংক্রমণ) হয়। অন্তত দুই সপ্তাহ যদি পরীক্ষা করা নমুনার ৫ শতাংশের কম পজিটিভ বা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয় এবং তিন সপ্তাহ ধরে যদি মৃত্যু ও সন্দেহভাজন মৃত্যু কমতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলে ধরা যাবে।

গত বছরের জুন-জুলাই মাসে দেশে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। ওই সময় প্রতি সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ হাজার রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। এরপর বিভিন্ন সময় নতুন রোগীর সংখ্যা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে গত টানা ৯ সপ্তাহ ধরে নতুন রোগী কমছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের জুন-জুলাই মাসে দেশে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। ওই সময় প্রতি সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ হাজার রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। এরপর বিভিন্ন সময় নতুন রোগীর সংখ্যা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে গত টানা ৯ সপ্তাহ ধরে নতুন রোগী কমছে। এর মধ্যে সর্বশেষ তিন সপ্তাহ ধরে প্রতি সপ্তাহে ৫ হাজারের কম রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সর্বশেষ সাত সপ্তাহ ধরে মৃত্যুও কমছে। রোগী শনাক্তের হারও টানা তিন সপ্তাহ ধরে ৫ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে সর্বশেষ তিন দিন শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে। তবে এখনো দেশের সব বিভাগেই নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে আজ সোমবার করোনা সংক্রমণের ১১তম মাস পূর্ণ হচ্ছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয়। বাংলাদেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্তের ঘোষণা আসে গত বছরের ৮ মার্চে। তবে সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে, আর জুনে তা তীব্র আকার ধারণ করে। মাস দু-এক সংক্রমণ কমার পর নভেম্বরের শুরু থেকে তা আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়। ডিসেম্বরে গিয়ে সংক্রমণ আবার কমতে শুরু করে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পরিস্থিতির সঠিক পর্যালোচনা করার জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ সন্দেহভাজন রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে না। আবার এখন যাঁদের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, তাঁদের একটি বড় অংশই বিদেশযাত্রী। তাঁরা করোনায় আক্রান্ত নন, এটা নিশ্চিত হতেই পরীক্ষা করান। অর্থাৎ সাধারণভাবে বলা যায়, তাঁদের লক্ষণ উপসর্গ নেই। অনেকে অন্যান্য চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন। গত এক মাসে দেশে করোনা পরীক্ষার জন্য যত নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, তার ৩৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ ছিল বিদেশযাত্রীদের নমুনা। যার ফলে পরীক্ষায় শনাক্তের হার থেকে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বোঝা কঠিন।

সংক্রমণের হার নিম্নগামী, টিকাও এসেছে। এটি ভালো সংবাদ। কিন্তু যেকোনো সময় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে এটি দেখা গেছে। সবাইকে টিকা দেওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন যে পরিস্থিতি তাতে নিবিড় নজরদারি জরুরি

একজন জনস্বাস্থ্যবিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আলাদা করা, তাঁদের সংস্পর্শে আসাদের চিহ্নিত করে সঙ্গনিরোধে নেওয়া—এসবও খুব কার্যকরভাবে হচ্ছে না। তাহলে কীভাবে সংক্রমণ কমছে, এটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এ ধরনের কোনো গবেষণাও নেই। সংক্রমণ কমে আসার একটি কারণ হতে পারে হার্ড ইমিউনিটি (বড় অংশের প্রতিরোধ ক্ষমতা) তৈরি হওয়া, সেটা হয়েছে কি না—সে সম্পর্কিত কোনো গবেষণাও নেই। তিনি বলেন, অনেকে হয়তো পরীক্ষা করাতে চাইছেন না। এখনো মৃত্যু হচ্ছে। যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন, তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা করাতে হবে। এখনো নতুন নতুন স্ট্রেইন (ভাইরাসের রূপান্তরিত ধরন) পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে কোথাও নতুন ধরন আছে কি না, তা জানা নেই। সব মিলিয়ে এখন বাড়তি সতর্কতা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি।

শনাক্ত ৫ লাখ ৩৮ হাজার ছাড়িয়েছে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রোববার পর্যন্ত দেশে মোট ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬২ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮ হাজার ২০৫ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৩৭২ জন। গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৯২ জন। রোগী শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

করোনার পরীক্ষা করছেন স্বাস্থ্যকর্মী

করোনার পরীক্ষা করছেন স্বাস্থ্যকর্মী 
ফাইল ছবি

মৃত্যুর হার ভারতকে ছাড়িয়েছে

শুরু থেকে দেশে করোনায় মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত, এমন দেশের তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে ভারত।

দীর্ঘদিন প্রতিবেশী এই দেশের চেয়ে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার কম ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার ভারতের চেয়ে সামান্য বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

১১তম মাসের চিত্র

দেশে সংক্রমণের ১১তম মাসে (৯ জানুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি) নতুন রোগী, মৃত্যু ও রোগী শনাক্তের হার এর আগের মাসের চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমেছে। ১১তম মাসে (আজ ৮ ফেব্রুয়ারি ১১তম মাস পূর্ণ হবে, আজকের দিন বাদে) নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৩৭২ জন, যা আগের মাসের তুলনায় ৫৫ শতাংশ কম। ১১তম মাসে মোট ৪৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের মাসের তুলনায় এই মাসে মৃত্যু কমেছে ৪৩ দশমিক ১২ শতাংশ। এই মাসে রোগী শনাক্তের হারও আগের মাসের চেয়ে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণের হার নিম্নগামী, টিকাও এসেছে। এটি ভালো সংবাদ। কিন্তু যেকোনো সময় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে এটি দেখা গেছে। সবাইকে টিকা দেওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন যে পরিস্থিতি তাতে নিবিড় নজরদারি জরুরি। কোথাও সংক্রমণ সামান্যতম বাড়তে দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, সাধারণত লক্ষণ বা উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষার ভিত্তিতে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। যাঁরা বিদেশযাত্রী এ ধরনের স্ক্রিনিংয়ের নমুনা ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এর বেশি হলে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র ঢেকে যায়। সে ক্ষেত্রে তাদের তথ্য আলাদা করে দেখানো প্রয়োজন।

কম কার্যকর করোনার টিকাও অত্যন্ত কাজের

করোনাভাইরাসের মহামারিতে পর্যুদস্ত বিশ্ব। তবে এ সংকটে আশার আলো হয়ে এসেছে টিকা। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই টিকা প্রয়োগও শুরু হয়ে গেছে। তবে এ পরিস্থিতিতে টিকার কার্যকারিতা নিয়ে মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন জেগেছে। টিকা নেওয়া, না নেওয়া নিয়েও অনেকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সবচেয়ে কম কার্যকর টিকাও অত্যন্ত কাজের।
দরিদ্র দেশগুলোয় টিকা কর্মসূচি জোরদারে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বের বৈশ্বিক জোট গ্যাভি, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়। শুক্রবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, করোনার টিকাগুলোর মানবদেহে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার প্রথম ফলাফল আসার আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, কোনো টিকার কার্যকারিতা ৫০ শতাংশের বেশি হলেই তা অনুমোদন পাওয়ার যোগ্য।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন করোনার বেশ কয়েকটি টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। দেশে দেশে অনুমোদনপ্রাপ্তির তালিকায় এখন শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেক উদ্ভাবিত করোনার টিকাটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এখন পর্যন্ত এ টিকার অনুমোদন দিয়েছে। মানবদেহে পরীক্ষায় টিকাটির ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার টিকাও ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রায় ৭০ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তবে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের (স্ট্রেইন) আবির্ভাবে টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের নোভাভ্যাক্স এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার পরীক্ষার ফলাফলে এ সংশয় আরও জোরালো হয়েছে। যদিও টিকা উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, করোনার নতুন ধরনের বিরুদ্ধেও এসব টিকা সুরক্ষা দিতে সক্ষম।

গবেষকেরা অবশ্য বলছেন, টিকায় পরিবর্তন আনা সম্ভব, যেমনটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লুর টিকায় প্রতিবছর আনা হয়। তবে করোনাভাইরাসের টিকায় এমন পরিবর্তনের প্রয়োজন না–ও পড়তে পারে। বিশেষ করে, যদি বিপুলসংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া যায় এবং এসব টিকা যদি মাঝারি মানের সুরক্ষাও দিতে পারে। এমনকি কম কার্যকর টিকাও সংক্রমণ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ কমাতে এবং করোনায় মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। সেদিক থেকে যেসব টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা তুলনামূলক অনেক বেশি কার্যকর।

ফাইজার-বায়োএনটেকের দাবি, তাদের উদ্ভাবিত করোনার টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর

ফাইজার-বায়োএনটেকের দাবি, তাদের উদ্ভাবিত করোনার টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর
ছবি: এএফপি

টিকার কার্যকারিতা বলতে কী বোঝায়

একটি টিকার কার্যকারিতা বলতে মূলত টিকাটি কতটা সুরক্ষা দিতে পারে, তাই বোঝায়। এ ক্ষেত্রে মানবদেহে টিকার পরীক্ষার ফলাফলের তুলনায় প্রকৃত সুরক্ষা হয়তো কিছুটা কম পাওয়া যেতে পারে। এর অন্যতম কারণ, পরীক্ষার সময় এ কর্মসূচিতে দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতার মানুষ যেমন কোনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তি, প্রবীণ অথবা গর্ভবতী নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

গ্যাভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি মানবদেহে পরীক্ষায় প্রায় ৭০ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে এটি আরও বেশি কার্যকর হতে পারে। কারণ, এ টিকা নেওয়ার পর টিকাগ্রহীতা কারও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বা মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। আর তা ছাড়া টিকাটি ৭০ শতাংশ কার্যকর মানে এই নয় যে টিকাটি গ্রহণ করলে ৭০ শতাংশ মানুষ সুরক্ষা পাবে, আর ৩০ শতাংশ মানুষ করোনা সংক্রমিত হবেন। এ টিকার পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৫ হাজার ৮০৭ জন স্বেচ্ছাসেবীর মধ্যে মাত্র ৩০ জন টিকা নেওয়ার পর করোনা সংক্রমিত হয়েছিলেন। একই পরীক্ষায় প্লাসিবো (প্রতিক্রিয়াহীন তরল) নেওয়া ৫ হাজার ৮২৯ জনের মধ্যে ১০১ জন করোনা সংক্রমিত হয়েছেন।

অন্যান্য টিকার কার্যকারিতা

করোনাভাইরাসের আগেও টিকার কার্যকারিতা আলোচনায় ছিল। এর মধ্যে কোনো টিকা প্রায় শতভাগ কার্যকর, আবার কোনোটা ৫০ শতাংশের কম কার্যকর। যেমন হাম–রুবেলার টিকা প্রথম ডোজ নিলে ৯৩ শতাংশ ও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর ৯৭ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। পোলিওর টিকাও দুই ডোজে ৯০ শতাংশ এবং তিন ডোজে ৯৯ শতাংশ থেকে শতভাগ কার্যকর। তবে মসকুইরিক্স আরটিএস,এস ম্যালেরিয়া টিকা চার ডোজ নেওয়ার পর ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ সুরক্ষা পাওয়া যায়। এ টিকা কেবল মালাউই, কেনিয়া ও ঘানার সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় অনুমোদন পেয়েছে। অন্যান্য অনুমোদনপ্রাপ্ত টিকার তুলনায় এ টিকার সাফল্যের হার মাঝারি। এখনো বিশ্বজুড়ে দিনে প্রায় ১ হাজার ২০০ শিশুর মৃত্যু হয়। সে ক্ষেত্রে এ সাফল্যের হারও অনেক বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।

কম কার্যকারিতা, বড় প্রভাব

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এ কারণে প্রতিবছর এসব ভাইরাসের টিকা হালনাগাদ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) প্রতিবছরই এসব টিকার সাফল্যের হার নির্ণয় করার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে দেশটিতে সংক্রমিত রোগী শনাক্তের সংখ্যা এবং এ রোগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার বিবেচনা করা হয়। সে বিবেচনায় ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকার কার্যকারিতা গত দশকে ৪৫ শতাংশ দেখা গেছে। আর ২০১৪–১৫ মৌসুমে এসব টিকার কার্যকারিতা দেখা গেছে মাত্র ১৯ শতাংশ। এ হার হয়তো অনেক কম। তারপরও টিকাগুলো এসব ভাইরাসের সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা বড় সংখ্যায় কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

বিজ্ঞানীদের প্রাক্কলিত হিসাব বলছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর প্রায় ৭ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন। এর মধ্যে ৪ লাখ ৭০ হাজার মানুষকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হতে পারে। মৃত্যু হতে পারে ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের।

গবেষকেরা হিসাব করে দেখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩ শতাংশ মানুষও যদি ফ্লুর বিরুদ্ধে ২০ শতাংশ কার্যকর টিকা নেন, তারপরও বছরে ১ লাখ ২৯ হাজার ৭০১ জনের সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি প্রতিরোধ সম্ভব। আর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব ৬১ হাজার ৮১২ জনের। এতে যে কেবল ফ্লুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে, তাই নয়।

স্থ্যব্যবস্থার ওপরও চাপ কমবে। ফলে অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীরাও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ পাবেন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট কোভিড–১৯ রোগ মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়েও প্রাণঘাতী। এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্য হলো টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ এবং মানুষের সুরক্ষা। তবে করোনার টিকা যদি কেবল রোগটিকে সাময়িক সময়ের জন্যও প্রতিরোধ করতে পারে, তাহলেও প্রতিবছর এতে আক্রান্ত হয়ে মানুষের অসুস্থ হওয়া ও মৃত্যু অনেক কমে আসবে।

দেশে ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যু- শনাক্তের সর্বশেষ তথ্য

দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে নতুন করে আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩০৫ জন। শনিবার বিকালে স্বাস্থ্য অধিদফতর এক বুলেটিনে দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির সর্বশেষ এ তথ্য জানিয়েছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন শনাক্ত ৩০৫ জনকে নিয়ে দেশে আক্রান্তে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৭৭০ জন। আরও আটজনের মৃত্যুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮ হাজার ১৯০ হয়েছে।

গত একদিনে বাসা ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ৪১৭ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ নিয়ে সুস্থ রোগীর মোট সংখ্যা বেড়ে  ৪ লাখ ৮২ হাজার ৮৪১ জন হয়েছে।

দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল গত ৮ মার্চ। এর ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। সে হিসাবে কোভিড-১৯ শনাক্তের ৩১১তম দিন পার করছে বাংলাদেশ।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে করোনা ভাইরাসের উপদ্রব শুরু হয়। এটি বর্তমানে বিশ্বের ২১৩ দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। ১১ মার্চ কোভিড ১৯-কে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

করোনা নিবন্ধনের ‘সুরক্ষা অ্যাপ’ আসছে ৪ ফেব্রুয়ারি

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকা গ্রহীতাদের নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনায় ৪ ফেব্রুয়ারি প্লে-স্টোরে ‘সুরক্ষা অ্যাপ’ চলে আসবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলম।

রোববার (৩১ জানুয়ারি) মহাখালীর জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে (নিপসম) আযোজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানান তিনি।

এ সময় তিনি বলেন, আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে একযোগে টিকা কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। নিবন্ধনের জন্য সুরক্ষা অ্যাপ প্রস্তুত রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যেই গুগল প্লে-স্টোরে অ্যাপটা আপলোড করেছি। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই এটা অনুমোদন হয়ে যাবে। তখন থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে।

তিনি আরও বলেন, আপাতত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আমাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলছে। সর্বশেষ খবর পেয়েছি ১৫ হাজারের মতো নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। আর যারা অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারবেন না, তাদের উপজেলা পর্যায়ে সহায়তা করবে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি আরও বলেন, দুয়েকদিনের মধ্যে দেশের ৬৪ জেলায় টিকা পৌঁছাবে। বেক্সিমকো ফার্মা আমাদের বলেছে আজ-কালের মধ্যে তারা জেলায় জেলায় টিকা পৌঁছে দেবে। সারাদেশে টিকা প্রয়োগের সব সরঞ্জামও প্রস্তুত আছে। টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের বুথগুলোকে প্রস্তুত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আগামীকালের মধ্যেই টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ শেষ হবে। সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আগামীকাল উপজেলার ফোকাল পার্সনদের ভার্চুয়াল একটা মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। তাদের থেকে যা পরামর্শ আসবে আগামী পাঁচ-ছয়দিনের মধ্যে সেগুলো নিয়ে কাজ করা হবে।

টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে সাত হাজার ৪০০টি দল কাজ করছে বলেও জানান ডা. খোরশেদ আলম।

বাংলাদেশে টিকার পরীক্ষা চালাতে চায় ভারত বায়োটেক

ভারতের প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক তাদের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকার পরীক্ষা চালাতে চায় বাংলাদেশে। এ জন্য তারা সম্প্রতি আবেদনও করেছে। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ কথা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালক মাহমুদ-উজ-জাহান রয়টার্সকে বলেছেন, ভারত বায়োটেকের কাছ থেকে এ রকম একটি প্রস্তাব তাঁরা পেয়েছেন। তাঁদের এথিকস কমিটি আবেদনটি পর্যালোচনা করবে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি সূত্রও রয়টার্সকে বলেছে, ভারত বায়োটেকের পক্ষে টিকা পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছে। তবে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি। ভারত বায়োটেকের মুখপাত্রদের তরফ থেকেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের এথিকস কমিটির প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভারতীয় এ কোম্পানির টিকা নিয়ে ট্রায়ালের আবেদন তাদের কমিটিতেই আসবে। সেখানে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিষয়টি নিয়ে তাঁদের মতামত জানাবেন। তবে এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই নেবে।

টিকা আসছে আজ

করোনাভাইরাসের টিকার জন্য বাংলাদেশের অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। ভারত সরকারের উপহারের ২০ লাখ ডোজ টিকা ঢাকায় আসছে। সকাল ১১টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে টিকা এসে পৌঁছার কথা জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। আর দুপুরের পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের পক্ষ থেকে তা হস্তান্তর করা হবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে।

অবশ্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা কোভিশিল্ডের তিন কোটি ডোজ কিনছে বাংলাদেশ। সেই টিকার প্রথম চালান ২৫-২৬ জানুয়ারি আসার কথা।

গতকাল বুধবার দুপুর ২টার দিকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বিষয়ক এক অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বৃহস্পতিবার ভারত থেকে ৩৫ লাখ ডোজ টিকা আসবে, যার মধ্যে উপহার ছাড়াও থাকছে চুক্তির প্রথম চালান হিসেবে ১৫ লাখ ডোজ। তবে সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংশোধনীতে চুক্তির টিকা আসার বিষয়টি বাদ রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে গণমাধ্যমের কাছে। অর্থাৎ আজ উপহারের ২০ লাখ ডোজই আসছে।

উপহারের এই টিকা আসার পর বিভিন্ন পর্যায়ের ২০-২৫ জনকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হবে। এরপর হবে মহড়া। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে সারা দেশে টিকা দেওয়া হবে। অবশ্য এসব প্রক্রিয়া কবে থেকে শুরু করা হবে তা জানানো হয়নি।

এ ছাড়া অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের প্রায় আট কোটি মানুষ টিকা নিতে পারবে না।

গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করবী হলে স্বাস্থ্য খাতের সাংবাদিকদের নিয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে টিকাসংক্রান্ত নানা তথ্য জানানো হয়। এতে করোনা মহামারি মোকাবেলায় গঠিত সরকারের জাতীয় সমন্বয় কমিটির মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজের নেতৃত্বে অংশ নেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম।

স্বাস্থ্যসচিব জানান, ১৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গঠিত সরকারের জাতীয় কমিটির একটি বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিতরণসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়। সে অনুসারে বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় ভারত থেকে ভারতীয় বিশেষ বিমানে ভারত সরকারের উপহারের যে টিকা আসবে তা গ্রহণ করবেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। এ সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তারাও থাকবেন। থাকবেন ভারতীয় হাইকমিশনারও। পরে ওই টিকা নিয়ে রাখা হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন স্টোরে। এরই মধ্যে সেই স্টোর প্রস্তুত হয়েছে।

আব্দুল মান্নান জানান, দেশে টিকা আসার পর প্রথমে কুর্মিটোলা বা কোনো একটি হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, সাংবাদিকদের একজন করে প্রতিনিধিকে টিকা দেওয়া হবে। তাঁদের ২০-২৫ জনের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে টিকা প্রয়োগ করে দেশে করোনার টিকাদান কর্মসূচি ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তী সময়ে ৪০০ থেকে ৫০০ স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়ে ঢাকার চারটি হাসপাতালে ড্রাই রান বা মহড়া দেওয়া হবে। এই হাসপাতালগুলো হচ্ছে—ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এরপর এক সপ্তাহ তাঁদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কি না। ফলাফল দেখে পরবর্তী সময়ে সারা দেশে টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হবে। তিনি জানান, যে মাসে শুরু হবে সে মাসে টিকা পাবে ৬০ লাখ মানুষ, দ্বিতীয় মাসে ৫০ লাখ, তৃতীয় মাসে আবার ৬০ লাখ।

সচিব বলেন, ‘আশা করছি পূর্বনির্ধারিত সময় অনুসারে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই সারা দেশে টিকা দেওয়ার কাজ শুরু করা যাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘করোনার টিকা আমরা ইপিআইর (সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি) মতো মাঠে-ঘাটে কেন্দ্র করে দিব না। এই টিকা দেওয়া হবে হাসপাতালে। যাতে করে কোনো সমস্যা হলে তাত্ক্ষণিক তা ম্যানেজ করা সহজ হয়।’

আব্দুল মান্নান জানান, টিকা দেওয়ার জন্য আইসিটি বিভাগ এরই মধ্যে একটি অ্যাপ তৈরির কাজ প্রায় শেষ করেছে। এ ছাড়া টিকা গ্রহণকারীদের জন্য ১৬২৬৩ নম্বরের একটি হটলাইনের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সার্ভিস রাখা হচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আপাতত সরকারিভাবেই টিকা দেওয়া হবে। বেসরকারি পর্যায়ে টিকা আনার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। কেউ টিকা আনলেও তা সরকারি নিয়ন্ত্রণে একই অ্যাপ ব্যবহার করে দিতে হবে।

কারা টিকা পাবে না জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, প্রথমত বিভিন্ন জটিল রোগের কারণে যাঁদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে গেছে, যাঁরা ক্যান্সারের রোগী কিংবা উচ্চমাত্রায় স্টেরয়েড নিচ্ছেন, যারা ১৮ বছর বয়সের নিচে, যাঁরা গর্ভবতী এবং যাঁরা দেশের বাইরে আছেন তাঁরা টিকা পাবেন না।

আইসিটির সিনিয়র সচিব বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় করোনার টিকা প্রয়োগের জন্য ‘সুরক্ষা’ নামের একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এখন সেটির পরীক্ষা চলছে। ২৩ জানুয়ারি এটার কাজ শেষ হবে এবং ২৫ জানুয়ারি তা চালুর জন্য প্রস্তুত থাকবে।

এ সময় আইসিটি বিভাগের অ্যাপ প্রস্তুতকারী দলের সদস্যরা কিভাবে অ্যাপটি কাজ করবে সেটা এক উপস্থাপনার মাধ্যমে দেখিয়ে দেন।

এ ছাড়া ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, টিকার খবরাখবর জানানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি মিডিয়া সেল চালু করা হয়েছে। প্রতিদিন সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হালনাগাদ তথ্য জানিয়ে দেওয়া হবে।

করোনাকালে অসহায় মানুষের ত্রাতা একজন মনীষা

সে এক ভীষণ ভয়ের সময়। চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনায় মৃত্যুর খবরগুলো যখন এ দেশের মানুষ পাচ্ছিল, সঙ্গে জানছিল করোনা ক্রমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, এ দেশেও করোনা আসবে কি না, সে আতঙ্কে তখন দিন কাটছে। ৮ মার্চ যখন এ দেশেই প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা হলো, মানুষের সে সময়টার আতঙ্কের সঙ্গে শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন আতঙ্কেরই তুলনা চলে। জাতির বড় দুটি ক্রান্তিকালের সূচনাই যে মার্চে, এ–ও এক কাকতালীয়ই বটে।

বরিশাল বিভাগে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৯ এপ্রিল পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায়। আর বরিশাল জেলায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১২ এপ্রিল। সারা দেশের মতো বরিশালের মানুষও তখন দিগ্ভ্রান্ত। এ ধরনের বৈশ্বিক মহামারিতে কী করতে হবে, সে অভিজ্ঞতা আগে ছিল না বললেই চলে। ফলে প্রথম দিকের আতঙ্ক আর লকডাউনে শ্রমজীবী, দরিদ্র মানুষগুলো সবচেয়ে প্রান্তিক হয়ে উঠেছিল। করোনা রোগী, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে যখন সবার অজানা আতঙ্ক, সুস্থ সচ্ছল মানুষ যখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে পরিবারের গণ্ডিতে, তখন মাঠে নামেন মনীষা। পুরো নাম মনীষা চক্রবর্তী। গত বছরের মার্চ থেকে আজও নিরলস আর অবিচল দৃঢ়তায় করোনা রোগী থেকে শুরু করে মানবেতর জীবন কাটানো মানুষদের সহায়তা করে চলেছেন তিনি।

চিকিৎসক মনীষা চক্রবর্তী

চিকিৎসক মনীষা চক্রবর্তী সাইয়ান

বরিশালের মানুষের কাছে মনীষার পরিচিতি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের নেতা হিসেবে। কিন্তু করোনাকালে তিনি আবির্ভূত যেন অসহায় মানুষের ত্রাতা হিসেবে। শুরুতে মানুষ যখন চিকিৎসা, খাদ্যসহ নানা সংকটে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন তিনি সতীর্থদের নিয়ে ভয়-শঙ্কা উপেক্ষা করে বিপন্ন মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটতে থাকেন কখনো অক্সিজেন নিয়ে, কখনো অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে নেওয়ার কাজে। আবার কখনো লকডাউনে খাবার সংকটে পড়া পরিবারগুলোর জন্য ছুটে যান রান্না করা খাবার নিয়ে।

করোনাকালে জীবিকা হারানো মানুষের জন্য বিনা মূল্যের বাজার-সওদা নিয়ে তিনি খুলেছেন মানবতার বাজার। সেখান থেকে বিনা মূল্যে বিতরণ করেছেন চাল, ডালসহ সব নিত্যপণ্য। তারপর করোনা সচেতনতা কার্যক্রম থেকে শুরু করে সংকটে পড়া পরিবারগুলোতে শিশুখাদ্য জোগান, লকডাউন বাসায় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিনা মূল্যে মেডিকেল স্ক্রিনিং, বিনা মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, বিনা মূল্যে অক্সিজেন ব্যাংক জোগান, করোনা দুর্যোগে খাদ্যসংকট মোকাবিলায় বীজ ও ফলের চারা বিতরণ—কোথায় ছিলেন না তিনি! পাশাপাশি অতিমারিকালে আসা মুসলমানদের ঈদ, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজার মতো প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলোতেও তিনি ও তাঁর সতীর্থরা উপহার-খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ছিলেন মানুষের পাশে।

এসব কারণেই মেহনতি মানুষের নেতা মনীষা এখন হয়ে উঠেছেন বিপন্ন মানুষের ত্রাতা। এসব মহতী কাজে মনীষার পেছনে ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল–বাসদের একঝাঁক তরুণ নেতা-কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক।

শৈশব থেকেই সংগ্রাম আর সেবার ব্রত

মনীষা অর্থ বুদ্ধি–প্রজ্ঞা। এই নামই যেন তাঁর পরিচয়। ছোটবেলা থেকেই বিতর্ক, খেলাধুলা, বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে জেলা-বিভাগীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বরিশালে পরিচিতি পান মেধাবী মনীষা। বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি এবং এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন অমৃত লাল দে কলেজে। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিকে ফের জিপিএ-৫ পেয়ে ভর্তি হন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে।

মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর ৩৪তম বিসিএসে সহকারী সার্জন হিসেবে স্বাস্থ্য ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মনীষা। কিন্তু চাকরিতে না গিয়ে তিনি মেহনতি মানুষের রাজনীতিতে নিজেকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যক্তিজীবনে ইচ্ছা করলে তিনি নির্বিঘ্ন জীবন পার করে দিতে পারতেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক মনীষার ব্যক্তিজীবনের ত্যাগ, অদম্য সংগ্রাম বরিশালের মানুষের কাছে বেশ পরিচিত।

করোনাযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবকদের মাঝে মনীষা চক্রবর্তী

করোনাযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবকদের মাঝে মনীষা চক্রবর্তী
ফাইল ছবি

কিন্তু এখনকার দিনে এই ত্যাগ আর ভোগবাদী-বিলাসী জীবনের প্রতি এই নির্লিপ্ততা কীভাবে এল তরুণ মনীষার? উত্তর খুঁজতে যেতে হয় তাঁর ঠিকুজি-কুলুজিতে। প্রগতিশীল পরিবারে জন্ম নেওয়া মনীষার পিতামহ বিশিষ্ট আইনজীবী শহীদ সুধীর কুমার চক্রবর্তী। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় রাজাকাররা তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মনীষার বাবা বিশিষ্ট আইনজীবী তপন কুমার চক্রবর্তী ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। প্রগতিশীল পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা মনীষার শৈশব অতিবাহিত হয় ফুফা বিশিষ্ট প্রকৃতিবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মার সংস্পর্শে।

মনীষা বর্তমানে বাসদের বরিশাল জেলার সদস্যসচিব। বাসদের নেতৃত্ব পাওয়ার পর শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি বরিশাল নগরের বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা আদায়ের সংগ্রামে প্রতিনিয়ত মাঠে থেকে একজন সংগ্রামী রাজনৈতিক যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। এ জন্য তাঁকে কারাবাসও করতে হয়েছে।

করোনাকালে ‘এক মুঠো চাল’ কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন মনীষা

করোনাকালে ‘এক মুঠো চাল’ কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন মনীষা
ফাইল ছবি

২০১৮ সালে বরিশাল সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন মনীষা। ভোটের দিন অনিয়মের প্রতিবাদে দুপুরে নির্বাচনে বর্জন করেন তিনি। তবে ভোট শেষ হলেও মাঠ ছাড়েননি তিনি। নানা রকম কার্যক্রমের মাধ্যমে মনীষা বরিশালবাসীর কাছে ইতিবাচক আলোচনার কেন্দ্রে আছেন। বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা নিয়ে, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ছাড়াও বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন নিজেদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে। লড়ে যাচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ ও তরুণদের নিয়ে।

করোনাযোদ্ধা মনীষার ছুটে চলা

করোনাকালের শুরুতে মনীষা মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পাশাপাশি শুরু করেন চিকিৎসা, সচেতনতা, খাদ্যসহায়তা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সহায়তাসহ বহুমুখী কাজ। লকডাউন ও লকডাউন–পরবর্তীকালে জরুরি রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য প্রথমে ১০টি ইজিবাইককে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করেন এবং ৭ জুলাই থেকে পূর্ণাঙ্গ একটি অ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করে রোগী পরিবহন করেন। এ কর্মসূচির নাম দেন ‘ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস’।

‘নির্ভয়’, ‘আস্থা’, ‘নির্ভীক’ ইত্যাদি নামে বরিশালজুড়ে গরিব রোগীদের সেবা দেয় মনীষাদের অ্যাম্বুলেন্সগুলো। এই কাজ করার জন্য গঠন করেন ২০ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবী দল। এ পর্যন্ত ৪৮৫ জন রোগীকে ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিয়েছেন।

‘মানবতার ঈদ উৎসব’ কর্মসূচির মাধ্যমে অসহায় মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার তুলে দিচ্ছেন মনীষা চক্রবর্তী

‘মানবতার ঈদ উৎসব’ কর্মসূচির মাধ্যমে অসহায় মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার তুলে দিচ্ছেন মনীষা চক্রবর্তী
ফাইল ছবি

২৮ জুন থেকে শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে অক্সিজেন সহায়তার জন্য খোলেন অক্সিজেন ব্যাংক। এই কর্মসূচির নাম ‘ফ্রি অক্সিজেন ব্যাংক’। ১৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৬০টি অক্সিমিটার দিয়ে এই সার্ভিস চালু করেন তাঁরা। এ পর্যন্ত তাঁরা ১১৫ জন রোগীকে বাসায় গিয়ে বিনা মূল্যে অক্সিজেন–সেবা দেন। এ কাজে সাতজন স্বেচ্ছাসেবী সার্বক্ষণিক কাজ করছেন।

এ ছাড়া ৮ জন দক্ষ স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে মে মাসজুড়ে বরিশালের বিভিন্ন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে দুটি দলে গণহারে মানুষের স্ক্রিনিং করার কার্যক্রম চালান তাঁরা। এতে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ মানুষের স্ক্রিনিং, ডেটা সংগ্রহ করে তাঁদের পরামর্শ দেন চিকিৎসক মনীষা ও তাঁর দল।

গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি থেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে আলোচনা সভা, বস্তিগুলোতে গিয়ে মানুষদের সচেতন করার কাজ শুরু করেন মনীষা। নগরের ৩০টি ওয়ার্ডে তাঁরা স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। মার্চ মাসের শুরুতে করোনা সচেতনতা তৈরিতে ৫০ হাজার লিফলেট বিতরণ করেন। ১৫ মার্চ থেকে নগরের বস্তিবাসী, স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে ১৭ হাজার বোতল জীবাণুনাশক তৈরি করে বিতরণ শুরু করেন। স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিয়ে বিতরণ করেন ২৫ হাজার মাস্ক।

শিশুখাদ্য ও মানবতার কৃষি কার্যক্রমে বীজ বিতরণ করছেন মনীষা চক্রবর্তী

শিশুখাদ্য ও মানবতার কৃষি কার্যক্রমে বীজ বিতরণ করছেন মনীষা চক্রবর্তী
ফাইল ছবি

লকডাউন পরিস্থিতি ও খাদ্যসংকটের কথা বিবেচনা করে ২২ মার্চ মনীষা ও তাঁর দল ‘আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাঁচুক প্রতিটি মানুষ’ এ স্লোগান নিয়ে খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি ‘এক মুঠো চাল’ সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেন। এক হাজার বাজারের ব্যাগ তৈরি করে নগরের বিভিন্ন বাড়িতে সরবরাহ করেন মুষ্টি চাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। এতে মানুষের ব্যাপক সাড়া পড়ে। দুই-তিন দিন পর থেকেই ব্যাগে চাল, আলু নিয়ে তাঁদের কার্যালয়ে পৌঁছে দিতে থাকে মানুষ। এই কর্মসূচির আওতায় এক মাসের বেশি সময় ধরে তাঁরা প্রতিদিন ২০০ পরিবারকে চাল, ডাল, আলু, তেল বিতরণ করেন।

মানবতার বাজার

করোনাকালে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আর্থিক সংকটের কারণে তাঁদের সহায়তার জন্য বাড়ি বাড়ি মুষ্টি চাল সংগ্রহ করে নগরের ফকিরবাড়ি রোডের একটি স্কুলমাঠে খোলেন বিনা মূল্যের বাজার কার্যক্রম। নগরের ফকিরবাড়ি সড়কের মাতৃছায়া স্কুলমাঠে ‘মানবতার বাজার’ নামে এই বাজার শুরু হয়। ১২ এপ্রিল থেকে এখানে মাস্ক, ওষুধ ছাড়াও চাল, ডাল, তেল, আলু, আটা, লবণ, বিভিন্ন সবজি, ডিমসহ ১৭টি খাদ্যপণ্য বিনা মূল্যে বিতরণ শুরু করেন। গড়ে প্রতিদিন দুই শতাধিক পরিবারকে এই বাজার থেকে প্রায় ৫০০ টাকার বাজার খাদ্যসহায়তা হিসেবে প্রদান করা হয়।

ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের উদ্বোধন করছেন মনীষা চক্রবর্তী

ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের উদ্বোধন করছেন মনীষা চক্রবর্তী
ফাইল ছবি

প্রায় পাঁচ মাস মাতৃছায়া স্কুলমাঠের পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে একাধিকবার এই বাজার পরিচালনা করা হয়। এ ছাড়া ‘মানবতার ঈদ বাজার’ নামে ঈদুল ফিতরে লাচ্ছা সেমাই, দুধ, চিনি পৌঁছে দেন ২ হাজার পরিবারে। ঈদুল ফিতরের আগে ১০০ এতিমখানার বাচ্চাদের নতুন পোশাক বিতরণ করেন তাঁরা। ১০টি এতিমখানায় খাবার এবং বেতন না পাওয়া ৫০ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে ২ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ প্রদান করেন। ঈদের দিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ২ হাজার ৫০০ দুস্থ পরিবারে রান্না করা উন্নত খাবার বিতরণ করেন। এ ছাড়া নগরের অক্সফোর্ড মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি স্কুলের বেতন না পাওয়া ৮৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে ৩ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ বিতরণ করেন। ঈদ উপলক্ষে নগরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাবের ৫০ জন শ্রমিককে ১ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ বিতরণ করেন।

কোরবানি ঈদে ১ হাজার পরিবারকে চাল, মাংস বিতরণ, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য ৫০০ প্যাকেট রান্না করা খাবারের আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার সময় ‘মানবতার শারদীয় উৎসব’ নামে ২০০ দুস্থ সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীকে শাড়ি এবং রান্না করা খাবার বিতরণ করেন।

১০টি ইজিবাইকের সঙ্গে ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে যোদ হওয়া অ্যাম্বুলেন্সটি

১০টি ইজিবাইকের সঙ্গে ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে যোদ হওয়া অ্যাম্বুলেন্সটি
ফাইল ছবি

বরিশাল শহর ছাড়াও মুলাদি, গৌরনদী, বাবুগঞ্জ (গুঠিয়া), বরগুনা, পটুয়াখালীতেও মানবতার বাজার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

শিশুদের খাদ্যসংকট সমাধানে মানবতার বাজারে ‘শিশু খাদ্য কর্নার’ করা হয়। এখান থেকে যেসব পরিবারে ৫ বছরের নিচে বাচ্চা আছে, তাদের পর্যাপ্ত শিশুখাদ্য প্রদান করা হয়। এভাবে করোনাকালে মোট ৭৬০ পরিবারকে শিশুখাদ্য বিতরণ করেন।
করোনা দুর্যোগে খাদ্যসংকট মোকাবিলায় ‘বরিশালের কোনো জমিই থাকবে না পতিত, সবুজে সবুজে ভরে উঠুক প্রতিটি আঙিনা’—এই স্লোগান সামনে রেখে মনীষা ও তাঁর স্বেচ্ছাসেবক দল মোট ১২ হাজার সবজি, লেবু, ফুল ও ফলের চারা এবং বীজ বিতরণ করেন।

প্রথম আলোর মুখোমুখি মনীষা

করোনাকালের এসব কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়ে মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি মানুষের জন্য। মানুষের দুর্যোগের সময় যদি মানুষের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হই, তাহলে সবকিছু বৃথা হয়ে যাবে। এ রাজনীতিরও কোনো মূল্য থাকবে না। তাই আমাদের সীমিত সামর্থ্য দিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি মানুষের পাশে থাকতে। জেলা বাসদের আহ্বায়ক ইমরান হাবিবের তত্ত্বাবধানে আমাদের সংগঠনের ছাত্র-শ্রমিক, নারী কর্মীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে এই কাজে নিয়োজিত ছিলেন। দেশ-বিদেশ থেকে সামর্থ্যবান ও মানবিক ব্যক্তিরা এবং আমাদের পার্টির কর্মীরা এতে আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।’

আমরা মাত্র ২২ হাজার টাকা হাতে নিয়ে কোটি টাকার বেশি আর্থিক সহায়তার কাজ করেছি, যা আমাদের কাছেও অভাবনীয় মনে হয়। আমি মনে করি ন্যায়নীতি-ভালোবাসা, মানুষ আর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে এটা সম্ভব।

মনীষা চক্রবর্তী

মনীষা বলেন, ‘আমরা মাত্র ২২ হাজার টাকা হাতে নিয়ে কোটি টাকার বেশি আর্থিক সহায়তার কাজ করেছি, যা আমাদের কাছেও অভাবনীয় মনে হয়। আমি মনে করি ন্যায়নীতি-ভালোবাসা, মানুষ আর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে এটা সম্ভব। এই কার্যক্রম চালাতে গিয়ে আমাদের রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে। অনেক বাধা এসেছে। কিন্তু মানুষের ভালোবাসা, সমর্থনে সেসব চক্রান্ত সফল হয়নি। যেকোনো দুর্যোগে আমরা এভাবে মানুষের পাশে থাকতে চাই, থাকব।’

করোনাযোদ্ধা মনীষার বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরিশাল জেলা সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, ‘মূলত রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে মানুষ, মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করা, সব মানবিক বিপর্যয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে এখন চিরায়ত সেই চরিত্র নেই। রাজনীতির এই আকালের মধ্যেও মনীষা চক্রবর্তীর মতো একজন রাজনৈতিক কর্মী সীমিত সামর্থ্য নিয়ে রাজপথের সংগ্রামের পাশাপাশি বিভিন্ন দুর্যোগে যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তা অভাবনীয়। এতে আমাদের অনেক হতাশার মধ্যেও আশা জাগায়।’