দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই মাস ধরে কমলেও ফের তা বাড়ছে। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আইসিইউতে রোগী বেড়েছে। ভিড় বাড়ছে অন্যান্য হাসপাতালেও। টিকা নেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণের হার আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সামনে ঈদ আসছে। ওই সময় দেশে করোনাভাইরাসের কাছাকাছি গোত্রের ভাইরাস ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুম শুরু হবে। তাছাড়া দেশে গরম পড়তে শুরু করেছে। এই সময়ে যদি সচেতনতা বাড়ানো না যায়, তবে ফের সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। কাজেই সারা দেশের মানুষকে মাস্ক পরতে হবে, ঘনঘন হাত ধুতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলতে হবে। নইলে সামনে বড় বিপদ বলে তারা সাবধান করেছেন। এ পরিস্থিতিতে ঈদের ছুটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না, সেই বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
করোনা সংক্রমণের এক বছরের মাথায় বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক যুগান্তরকে বলেন, আমরা করোনা সংক্রমণের এক বছর পার করছি। প্রথম থেকেই করোনা নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমে এসেছে। টিকা নেওয়ার পর মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি শৈথিল্য দেখা দিয়েছে। তারা বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে বেড়াতে যাচ্ছেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করছেন; কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এতে আবার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়তে শুরু করেছে। জাহিদ মালেক বলেন, টিকাদান মানে এই নয় যে দেশ করোনামুক্ত হয়ে গেছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দেশের মানুষকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। বিশেষ করে মাস্ক বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
তিনি বলেন প্রথম থেকেই হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো, ডাক্তার-নার্সদের প্রশিক্ষাণ, আইসিইউ শয্যা বাড়ানো, ৯০টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম স্থাপন, রোগীদের সুরক্ষায় পালস অক্সিমিটার নিশ্চিত করা, হাইফ্লো নেজাল ক্যানোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোভিড নিয়ন্ত্রণে সব প্রয়োজনীয়তা মেটাতে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংক্রমণ কমাতে আমরা ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ কার্যকর করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী নিজেই আমাদের এই উদ্যোগে স্বাগত জানিয়েছেন। এভাবে বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক মহামারি প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। আমরা সংক্রমণের হার ৩-এর নিচে এবং মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হই। এরপর মহামারি নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে দ্রুত টিকার ব্যবস্থা করলেন। তার প্রচেষ্টায় আমরা অনেক দেশের আগেই টিকাদান শুরু করেছি। যেখানে ভারতে ৬০ বছরের বেশি বয়সিদের টিকা দিচ্ছে, সেখানে আমরা ৪০ বছরে নামিয়ে এনেছি।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এক বছর আজ। ২০২০ সালের এই দিনে (৮ মার্চ) সরকারের পক্ষ থেকে দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনা সংক্রমণের বিষয়টি জানানো হয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত দেশে সাড়ে ৫ লাখ মানুষ সংক্রমণের শিকার হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষের। গত মাসে টিকাদান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৭ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অচিরেই সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ টিকার সুবিধা পেতে আরও অন্তত এক বছর লাগবে। তাছাড়া ঈদের ছুটির সময় আমাদের দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুম শুরু হবে। পাশাপাশি ঈদকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের যাতায়াত বাড়বে। সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নতুন করে করোনার সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না। তিনি বলেন, গত ঈদের পরই সংক্রমণের হার পিকে উঠেছিল। সেসময় লকডাউন শিথিল হয়ে গিয়েছিল। এতে মহাবিপর্যয় ঘটতে পারত। সেটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
তিনি বলেন, দেশে গত বছরের ৮ মার্চ করোনার প্রথম সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর আমরা দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম। তারপরেই সারা দেশে লকডাউন কার্যকর করা হয়। ফলে মহামারি ধীরগতি পেয়েছিল। এতে আমরা আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে করোনা নিয়ন্ত্রণে এবং আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সম্পর্কে জেনেছি। ফলে মহামারি নিয়ন্ত্রণ বা সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়েছিল। তাই এখন আসন্ন গরম, ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুম ইতাদি বিষয় মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এসএম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, টিকা নিই আর না নিই, স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, এটা উদ্বেগজনক। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, দেশে করোনা মহামারির এক বছর হওয়ার আগেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। কিন্তু অসচেতনতার কারণে আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী বাড়ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী বাড়ছে। এমনকি যারা বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে গিয়েছে, তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ একদল মানুষ আনন্দভ্রমণে বেরিয়ে বিপদ ডেকে আনছে। তিনি বলেন, এসব বিষয় মাথায় রেখে ঈদের ছুটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।