দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী, মৃত্যু, নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার—সবই বেশ কিছুদিন ধরে নিম্নমুখী। সে সঙ্গে সারা দেশে শুরু হয়েছে টিকাদান কার্যক্রম। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দৃশ্যত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পথে থাকলেও বিপদ কেটে গেছে, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। কারণ, এখনো ট্রান্সমিশন (সংক্রমণ ছড়ানো) চলছে।
ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনসহ ইউরোপের অনেক দেশে পরিস্থিতি দু–তিন মাস নিয়ন্ত্রণে থাকার পর সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। তখন সংক্রমণ আরও বেশি ছড়িয়েছে।
দেশেও যেকোনো সময় আবার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য তাঁদের পরামর্শ হচ্ছে, নিবিড় নজরদারি বহাল রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
একটি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি না, তা বুঝতে কিছু নির্দেশক ঠিক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছে, সংক্রমণের সর্বশেষ চূড়ান্ত পর্যায় (পিক) থেকে টানা তিন সপ্তাহে যদি রোগী ও সন্দেহভাজন (উপসর্গ রয়েছে) অন্তত ৫০ শতাংশ কমে। অন্তত ৮০ শতাংশ সংক্রমণ যদি নির্দিষ্ট ক্লাস্টারে (একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কাছাকাছি থাকা অনেকের মধ্যে সংক্রমণ) হয়। অন্তত দুই সপ্তাহ যদি পরীক্ষা করা নমুনার ৫ শতাংশের কম পজিটিভ বা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয় এবং তিন সপ্তাহ ধরে যদি মৃত্যু ও সন্দেহভাজন মৃত্যু কমতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলে ধরা যাবে।
গত বছরের জুন-জুলাই মাসে দেশে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। ওই সময় প্রতি সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ হাজার রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। এরপর বিভিন্ন সময় নতুন রোগীর সংখ্যা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে গত টানা ৯ সপ্তাহ ধরে নতুন রোগী কমছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের জুন-জুলাই মাসে দেশে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। ওই সময় প্রতি সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ হাজার রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। এরপর বিভিন্ন সময় নতুন রোগীর সংখ্যা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে গত টানা ৯ সপ্তাহ ধরে নতুন রোগী কমছে। এর মধ্যে সর্বশেষ তিন সপ্তাহ ধরে প্রতি সপ্তাহে ৫ হাজারের কম রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সর্বশেষ সাত সপ্তাহ ধরে মৃত্যুও কমছে। রোগী শনাক্তের হারও টানা তিন সপ্তাহ ধরে ৫ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে সর্বশেষ তিন দিন শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে। তবে এখনো দেশের সব বিভাগেই নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে আজ সোমবার করোনা সংক্রমণের ১১তম মাস পূর্ণ হচ্ছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয়। বাংলাদেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্তের ঘোষণা আসে গত বছরের ৮ মার্চে। তবে সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে, আর জুনে তা তীব্র আকার ধারণ করে। মাস দু-এক সংক্রমণ কমার পর নভেম্বরের শুরু থেকে তা আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়। ডিসেম্বরে গিয়ে সংক্রমণ আবার কমতে শুরু করে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পরিস্থিতির সঠিক পর্যালোচনা করার জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ সন্দেহভাজন রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে না। আবার এখন যাঁদের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, তাঁদের একটি বড় অংশই বিদেশযাত্রী। তাঁরা করোনায় আক্রান্ত নন, এটা নিশ্চিত হতেই পরীক্ষা করান। অর্থাৎ সাধারণভাবে বলা যায়, তাঁদের লক্ষণ উপসর্গ নেই। অনেকে অন্যান্য চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন। গত এক মাসে দেশে করোনা পরীক্ষার জন্য যত নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, তার ৩৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ ছিল বিদেশযাত্রীদের নমুনা। যার ফলে পরীক্ষায় শনাক্তের হার থেকে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বোঝা কঠিন।
সংক্রমণের হার নিম্নগামী, টিকাও এসেছে। এটি ভালো সংবাদ। কিন্তু যেকোনো সময় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে এটি দেখা গেছে। সবাইকে টিকা দেওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন যে পরিস্থিতি তাতে নিবিড় নজরদারি জরুরি
একজন জনস্বাস্থ্যবিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আলাদা করা, তাঁদের সংস্পর্শে আসাদের চিহ্নিত করে সঙ্গনিরোধে নেওয়া—এসবও খুব কার্যকরভাবে হচ্ছে না। তাহলে কীভাবে সংক্রমণ কমছে, এটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এ ধরনের কোনো গবেষণাও নেই। সংক্রমণ কমে আসার একটি কারণ হতে পারে হার্ড ইমিউনিটি (বড় অংশের প্রতিরোধ ক্ষমতা) তৈরি হওয়া, সেটা হয়েছে কি না—সে সম্পর্কিত কোনো গবেষণাও নেই। তিনি বলেন, অনেকে হয়তো পরীক্ষা করাতে চাইছেন না। এখনো মৃত্যু হচ্ছে। যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন, তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা করাতে হবে। এখনো নতুন নতুন স্ট্রেইন (ভাইরাসের রূপান্তরিত ধরন) পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে কোথাও নতুন ধরন আছে কি না, তা জানা নেই। সব মিলিয়ে এখন বাড়তি সতর্কতা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি।
শনাক্ত ৫ লাখ ৩৮ হাজার ছাড়িয়েছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রোববার পর্যন্ত দেশে মোট ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬২ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮ হাজার ২০৫ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৩৭২ জন। গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৯২ জন। রোগী শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মৃত্যুর হার ভারতকে ছাড়িয়েছে
শুরু থেকে দেশে করোনায় মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত, এমন দেশের তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে ভারত।
দীর্ঘদিন প্রতিবেশী এই দেশের চেয়ে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার কম ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার ভারতের চেয়ে সামান্য বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
১১তম মাসের চিত্র
দেশে সংক্রমণের ১১তম মাসে (৯ জানুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি) নতুন রোগী, মৃত্যু ও রোগী শনাক্তের হার এর আগের মাসের চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমেছে। ১১তম মাসে (আজ ৮ ফেব্রুয়ারি ১১তম মাস পূর্ণ হবে, আজকের দিন বাদে) নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৩৭২ জন, যা আগের মাসের তুলনায় ৫৫ শতাংশ কম। ১১তম মাসে মোট ৪৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের মাসের তুলনায় এই মাসে মৃত্যু কমেছে ৪৩ দশমিক ১২ শতাংশ। এই মাসে রোগী শনাক্তের হারও আগের মাসের চেয়ে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণের হার নিম্নগামী, টিকাও এসেছে। এটি ভালো সংবাদ। কিন্তু যেকোনো সময় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে এটি দেখা গেছে। সবাইকে টিকা দেওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন যে পরিস্থিতি তাতে নিবিড় নজরদারি জরুরি। কোথাও সংক্রমণ সামান্যতম বাড়তে দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, সাধারণত লক্ষণ বা উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষার ভিত্তিতে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। যাঁরা বিদেশযাত্রী এ ধরনের স্ক্রিনিংয়ের নমুনা ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এর বেশি হলে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র ঢেকে যায়। সে ক্ষেত্রে তাদের তথ্য আলাদা করে দেখানো প্রয়োজন।