করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন মহামারির বিস্তার ঠেকানোর সুযোগ এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস বিস্তারের দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। নতুন সংক্রমণ বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। কিন্তু এরই মধ্যে আশার আলো দেখছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও সিএনএনের স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশ্লেষক ড. জোনাথন রেইনারের মতে, ‘আগামী দুই মাসে আমরা বহু মানুষকে মরতে দেখব। কিন্তু আশার আলোও আছে। গত কয়েক মাসের মধ্যে গত চার দিনে প্রথমবারের মতো ধারাবাহিকভাবে নতুন সংক্রমণ ও কোভিড-১৯ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এই চার দিনে কোভিড-১৯ নিয়ে হাসপাতালে দৈনিক ভর্তির সংখ্যা প্রায় এক হাজার করে কমেছে।
সিএনএন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে এখন প্রতিদিন গড়ে কোভিড-১৯ নিয়ে ১ লাখ ২৪ হাজারের মতো রোগী ভর্তি হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগেও এ সংখ্যা ছিল দৈনিক গড়ে ১ লাখ ৩২ হাজার। প্রতি দিনই করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ আগে করোনা শনাক্তের হার যেখানে ১৪ শতাংশ ছিল, এখন তা কমে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আমরা চূড়াটি এরই মধ্যে পার হয়ে গেছি। যদি আমরা মাস্ক পরি এবং নিয়ম মানি, আর যত দ্রুত সম্ভব টিকা নিই, তবে আমরা করোনার বিস্তার রোধ শুরু করতে পারব
এ বিষয়ে জোনাথন রেইনার বলেন, ‘অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আমরা চূড়াটি এরই মধ্যে পার হয়ে গেছি। যদি আমরা মাস্ক পরি এবং নিয়ম মানি, আর যত দ্রুত সম্ভব টিকা নিই, তবে আমরা করোনার বিস্তার রোধ শুরু করতে পারব।’
তবে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু কিন্তু খুব একটা কমেনি। এই সংখ্যা এমন গতিতে এগোচ্ছে যে, খুব দ্রুতই মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪ লাখ ছুঁয়ে ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে কোভিড-১৯–এর নতুন স্ট্রেইনের বিপদ, যা বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ছড়াতে শুরু করেছে। প্রতি সপ্তাহে নতুন এই স্ট্রেইনে সংক্রমিত লোকের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) সাবেক কমিশনার ড. স্কট গটলিব।
সিবিএস নিউজের ‘ফেস দ্য নেশন’ অনুষ্ঠানে গটলিব বলেন, ‘আগামী পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে নতুন এই স্ট্রেইন আগেরটির জায়গা দখল করবে বলে মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র সুখবর হচ্ছে, সে (নতুন স্ট্রেইন) কর্তৃত্ব নেওয়ার আগেই আমাদের বহু মানুষ সংক্রমিত হয়ে যাবে এবং বহু লোক টিকা গ্রহণ করবে। ফলে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে একটা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি থাকবে। কিন্তু তারপরও এটি করোনা মোকাবিলার সমীকরণকে জটিল করে তুলেছে। আগামী বসন্ত নাগাদ নতুন করে আবার সংক্রমণ হতে পারে এই নতুন স্ট্রেইন দ্বারা।’
নতুন স্ট্রেইনটি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউসি গতকাল রোববার এনবিসি নিউজকে বলেছেন, ‘কোভিড-১৯–এর নতুন এই স্ট্রেইন অতটা প্রাণঘাতী না হলেও তা অনেক মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এমনিতে এটি আগেরটির মতো অত বেশি অসুস্থ করে না বা শুধু এর সংক্রমণের কারণেই মৃত্যু হবে—এমনটাও হয়তো নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এটি যত বিস্তার পাবে, তত বেশি লোক অসুস্থ হবে। যত বেশি অসুস্থ হবে, তত বেশি লোককে ছুটতে হবে হাসপাতালের দিকে এবং সে ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে।’
এরই মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন ছড়িয়ে পড়েছে। এটি আগেরটির চেয়ে দ্রুত ছড়ায় কিনা, তা এখনো নিশ্চিত না হলেও অঙ্গরাজ্যগুলোর কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের প্রতি স্বাস্থ্য সতর্কতা পালনের বিষয়ে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও করোনা মহামারি মোকাবিলাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
শীতের এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু ব্যাপকভাবে বেড়েছে। শুধু জানুয়ারিতেই ৩৯ লাখ মানুষের শরীরে নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে; মারা গেছে ৫১ হাজার। চলতি মাসের তিন দিন ছাড়া বাকি সব দিনই নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ২ লাখের বেশি। দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যায় একের পর এক রেকর্ড হয়েছে। খুব দ্রুতই এই মৃত্যুর সংখ্যা চার লাখ ছুঁয়ে ফেলবে, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও কোরীয় যুদ্ধে নিহত মার্কিনদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত মার্কিনের সংখ্যাকেও ছুঁয়ে ফেলতে পারে। আর সিডিসির পূর্বাভাস সত্য হলে এই সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
এ অবস্থায় মার্কিন প্রশাসন, বিশেষ করে ২০ জানুয়ারি শপথ নিতে যাওয়া জো বাইডেন প্রশাসন করোনা টিকা দেওয়ার কর্মসূচি সম্প্রসারণের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। জো বাইডেন ঘোষিত নতুন নাগরিক প্রণোদনা প্যাকেজেও এ সম্পর্কিত তহবিলে বাড়তি অর্থ রাখা হয়েছে। সিডিসির তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ১ কোটি ২২ লাখ মার্কিন করোনা টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন। পুরো দেশে ৩ কোটি ১০ লাখের বেশি ডোজ সরবরাহ করা হয়েছে। এই সরবরাহ ও টিকা বিতরণের হার আরও ব্যাপকভাবে বাড়ানোর ওপরই এখন সবাই গুরুত্ব দিচ্ছেন। আশার আলো দেখা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও এই টিকা কর্মসূচির সাফল্যের ওপরই সবচেয়ে বড় বাজিটি রেখেছেন।