বৈদ্যুত খাতে দূর্নীতি: মদদ দেয় মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু

বৈদ্যুত খাতে দূর্নীতি: মদদ দেয় মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু

মশিউল হুসাইন খান/ যুক্তরাজ্য

হাসিনাসহ আওয়ামীলীগের নেতারা সব সময় বলে বিদুৎখাতে তারা সফল। দেশে দিনে ঘন্টায় ঘন্টায় বিদুৎ যায় তারপরও তারা এই কথা বলে। আবার আমাদের দেশে কোনো কিছুর দাম কমে না, কেবল বাড়ে , বাড়তেই থাকে। সর্বশেষ বাড়ল বিদ্যুতের দাম। কিন্তু এমন করে হুট হাট করে বিদুৎতের দাম বাড়ার কারন কি। আর এর পেছনে কার দায় রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে অপব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের পকেটে হাত দিয়েছে। ৯ হাজার কোটি টাকার উপরে অযৌক্তিক ব্যয় যদি সমন্বয় করা হত, তাহলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হত না। সরকার রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মুনাফা অর্জন ও লুণ্ঠনের এক অভয়ারণ্য তৈরি করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই লুটপাটের দায় জনগণ কেন নেবে?

দেশের বিদ্যুৎখাত নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আর তদন্তে বিভিন্ন সময় দুদক উদ্যোগ নিলেও তা পরবর্তীতে আর আশার আলো দেখেনি। দেখবে কি করে এই দূর্নীতির সাথে তো সরকারের পৃষ্ঠপোষকে যারা আছেন তারা জড়িত।  সত্যি বলতে ,বর্তমান সরকার যে খাতে নিজেদের সবচেয়ে’ সফল বলে দাবি করে তা হচ্ছে বিদ্যুৎখাত। কিন্তু এই খাতেই দূর্ণীতি সব থেকে বেশি। এই খাতের ভেতরের দুর্নীতি নিয়ে যে অন্ধকার রাজত্ব তা থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালেই। বিদ্যুৎ খাতের প্রধান প্রতিষ্ঠান পিডিবি বরাবরই দুর্নীতিতে অনেক এগিয়ে। সংস্থাটির খোদ শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাই এখন লাগামহীন দুর্নীতি-অপকর্মে নিমজ্জিত। এ খাতের দুর্নীতিবাজরা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছেন ঊর্ধ্বতন মহল থেকে অর্থাৎ বিদ্যু মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী তাদের লালন পালন করছে।

এই খাতের মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও পিডিবির বর্তমান চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুরেদ সাথে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এছাড়া সরকারের আর একজন উধ্বতর নেতা সালমান এফরহমানের সাথেও রয়েছে ঘনিষ্ঠতা। দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কাজ করেছেন তিনি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয় খালেদকে। কিন্তু দীর্ঘ ৩৮ বছরের চাকরি জীবনে মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞাতা তার নেই বললেই চলে। পিডিবিকেন্দ্রীক দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের প্রধান সদস্য হিসেবে তিনি কেন্দ্রীয় পর্যায়ের বিভিন্ন আকর্ষণীয় পদে কাজ করেছেন। আর সংস্থার চেয়ারম্যান হওয়ার পর তিনি নিজেই এখন সিন্ডিকেটের পুরো নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পিডিবিতে যে গ্রুপটি সব সময়ই বিশেষভাবে শক্তিশালী তা হচ্ছে ঠিকাদার গ্রুপ। সরকারী নেতাদেও কাজ পাইয়ে দিতে তিনি গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে শুধু পিডিবির চেয়ারম্যান বা এর কর্মকর্তারাই জড়িত নন, মন্ত্রণালয় বা অন্যান্য স্থানের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এই সিন্ডিকেটে আছেন। তবে তাদের এই সিন্ডিকেটের টাকার বড় অংশ যায় মন্ত্রীর কাছে। আর সে কারনে মন্ত্রী সব দেখেও চুপ থাকেন।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের সংস্কারসহ নানা কাজে যে পরিমাণ দুর্নীতি আর লুটপাট হয় তা অকল্পনীয়। সবচেয়ে বড় রকমের চুরি হয়ে থাকে কেনাকাটার টেন্ডারে। যাকে ‘চুরি’ না বলে ‘লুট’ বলেই আখ্যায়িত করে থাকেন অভিজ্ঞমহল। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাঘব বোয়ালরা। প্রতিবছর এই ক্রয় খাতে শত শত কোটি টাকা লুট হচ্ছে নানা কায়দায়। যার ভাগ যায় গুটিকয়েক কর্মকর্তা ও সংস্থার বাইরের ব্যক্তিবিশেষের পকেট। খালেদ মাহমুদই ইতিপূর্বে প্রধান প্রকৌশলী থাকার সময় আড়াই হাজার কোটি টাকা লুটপাটের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এজন্য ২০১৪ সালে দুদকের তদন্ত এবং জিজ্ঞাসাবাদেরও মুখোমুখি হয়েছিলেন। অবশ্য খালেদ মাহমুদ বরাবরই ‘ম্যানেজ মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত। ম্যানেজিং সক্ষমতার মাধ্যমে দুদকের সেই তদন্ত কোনো রকমে ধামাচাপা দিয়েছেন।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীন বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামত খাতে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়ে থাকে। আর একে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে যে কোন ধরণের অনিয়ম আর কৌশলের আশ্রয় নিতে দ্বিধা করে না এই সিন্ডিকেট। এই বহিরাগতরাও বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানির মালিক বা বড় বড় কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতারাও আছেন এই সিন্ডিকেটে। পিডিবির কোন কাজ এলেই দরদাতাদের নিজেদের মধ্যে অলিখিত গোপন সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়, বেশি দর হাঁকিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে। দেখা যায়, কখনো কখনো সবদিক থেকে যোগ্য হওয়ার পরও সর্বনিম্ন দরদাতার দর বিভিন্ন অযৌক্তিক অজুহাত দেখিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। নানান কৌশলে নিম্নদরদাতাকে বাদ দিয়ে উচ্চ ও অস্বাভাবিক মূল্যে মালামাল ক্রয় করা হয়ে থাকে। অতীতে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে, এখনো ঘটছে।

পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ সারাজীবনই পিডিবির প্রধান কার্যালয়ে ডিজাইন, প্রোগ্রাম এবং প্ল্যানিং বিভাগে কাজ করেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পিডিবির এই শাখা সাধারণত দুর্নীতিবাজদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় শাখা হিসেবে পরিচিত। এর কারণ, এগুলো ক্রয় বা কেনা-কাটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বড় দুর্নীতিগুলো হয়ে থাকে এই শাখার মাধ্যমেই। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, চাকরি জীবনের শুরু থেকেই তিনি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

এ শাখা যেভাবে ডিজাইন এবং পরিকল্পনা করে দেন টেন্ডারটির স্পেসিফিকেশন সেভাবেই তৈরি হয়। এতে কাজ পায় তাদের পছন্দের ওই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানই। অর্থাৎ কে কাজ পাবে, এটা টেন্ডার আহ্বানের আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়। এসব শাখায় নিজের পছন্দের লোকদের শুধু নিয়োগই দেননি, তারা সবাই চেয়ারম্যানের প্রতি অন্ধ অনুগত, কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির লোকজনও এই সিন্ডিকেটের সদস্য।

নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি সবকিছুতেই অনিয়ম

আর একজন পিডিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হচ্ছেন সদস্য (প্রশাসন) জহুরুল হক। তিনি পিডিবিতে নিয়োগ বাণিজ্যের এক মহা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। রয়েছে সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠতা।  ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় বা বুয়েটের মতো খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হলেও ফলাফলে অভিনব জালিয়াতি করা হয়। যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, ফলাফল প্রকাশের আগেই তাদের সাথে যোগাযোগ করে এই সিন্ডিকেট, তারপর পাস করিয়ে দেয়ার জন্য চুক্তি করে। পরীক্ষায় স্বাভাবিকভাবে পাস করলেও পরীক্ষার্থীরা জানতেও পারেন না যে তারা মেধার বলেই টিকেছেন, টাকা দেয়ার ফলেই তাদের উত্তীর্ণ করা হয়েছে এমন ধারণা সৃষ্টি করার পর ওই ব্যক্তিরা চাকরি পেতে এই সিন্ডিকেটের কাছে টাকা দিতে আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন না। জানা গেছে, জহিরুল হকের সকল অনিয়ম-দুর্নীতিতে সহযোগিতা করছেন তার আত্মীয় মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন সিন্ডিকেট সদস্য।

জহিরুল হক পিডিবিতে চেয়ারম্যানের ডানহাত হিসেবে পরিচিত, বস্তুতঃপক্ষে খালেদ মাহমুদকে ব্যবহার করেই সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন জহিরুল হক। আর খালেদ মাহমুদ যিনি কার্যতঃ অবসরেই গিয়েছিলেন তিনি আবার নতুন করে নিয়োগ পাওয়াকে ক্রিকেটের ভাষায় ’লাইফ’ পাওয়া বলে মনে করছেন। তিনি তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন- ‘লাইফ’ যখন পেয়েছি যতদূর পারি ‘রান’ তুলে নিই। এই ‘রান’ হচ্ছে ‘নগদ নারায়ণ’ এমনটাই বলছেন পিডিবি সংশ্লিষ্টরা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *