হাসপাতালে হঠাৎ রোগীর চাপ

হাসপাতালে হঠাৎ রোগীর চাপ

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ২৭৫টি। এই হাসপাতালে গতকাল সোমবার রোগী ভর্তি ছিলেন ২৫৬ জন। অর্থাৎ প্রায় ৯৩ শতাংশ শয্যাতেই রোগী ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালটির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ১০টি শয্যার কোনোটিই ফাঁকা ছিল না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, কয়েক দিন ধরে করোনায় সংক্রমিত যেসব রোগী আসছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই শ্বাসকষ্ট তীব্র।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে করোনার জন্য নির্ধারিত ৯টি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১১৭টি। এর মধ্যে ৮১টি শয্যাতেই গতকাল রোগী ভর্তি ছিলেন। ফাঁকা ছিল ৩৬টি শয্যা, অর্থাৎ ৬৯ শতাংশের বেশি রোগী আইসিইউতে ছিলেন। আর করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ২ হাজার ৩৮১টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১ হাজার ২৮১টি শয্যায় রোগী ভর্তি ছিলেন। অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ শয্যাতেই রোগী ছিলেন। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তখন ৩০ শতাংশ শয্যায় রোগী ছিলেন।

অবশ্য ঢাকার বাইরে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ এখনো কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বাদে সারা দেশে করোনার জন্য নির্ধারিত সাধারণ শয্যা রয়েছে ৬ হাজার ৪০৩টি। এসব হাসপাতালে গতকাল ভর্তি ছিলেন ৩১১ জন। খালি ছিল ৬ হাজার ৯২টি শয্যা। অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ শয্যা খালি ছিল।

গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় তিন মাস দেশে সংক্রমণ মোটামুটি কম ছিল। তবে চার সপ্তাহ ধরে দেশে দৈনিক শনাক্ত বাড়ছে। পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হারও ঊর্ধ্বমুখী। গত ৯০ দিনের মধ্যে এক দিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছে গতকাল।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা, তাঁর স্ত্রী ও শাশুড়ির গত সপ্তাহে করোনা শনাক্ত হয়। তাঁরা তিনজনই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে ওই ব্যক্তির শাশুড়ির শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর (সোহরাওয়ার্দীতে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ নেই) করা হয়। গত রোববার রাতে তিনি মারা যান।

আইসিইউ শয্যা ফাঁকা থাকছে না, সাধারণ শয্যাতেও রোগী ভর্তি থাকছেন। দেশে আবার করোনা রোগী বাড়তে শুরু করেছে, এটি তারই ইঙ্গিত।

আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালের গত ১৫ দিনের তথ্য দেখলেই বোঝা যায়, করোনা রোগী বাড়ছে। মাঝে কিছুদিন করোনা কম থাকায় লোকজন বেশি উদাসীন হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অধিকাংশই বলছেন, সামাজিক অনুষ্ঠান ও ভ্রমণ থেকে তাঁরা সংক্রমিত হয়েছেন। রোগীদের অনেকেরই তীব্র শ্বাসকষ্ট থাকছে।

সোহরাওয়ার্দীর মতোই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও রোগী বাড়ছে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ৬০ থেকে ৭০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। গতকাল রোগী ভর্তি ছিলেন ১৫৩ জন। এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১৪টি। গতকাল প্রতিটি শয্যাতেই রোগী ছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণের বেশি রোগী বেড়েছে মার্চে।

মুগদা হাসপাতালের আটতলার পুরুষ ওয়ার্ডে করোনার চিকিৎসা নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ খানপুরের বাসিন্দা ৮৪ বছর বয়সী কার্তিক বর্মণ এবং তাঁর ছেলে ২৭ বছর বয়সী টিটো বর্মণ। ১২ মার্চে তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হন।

কার্তিক বর্মণের আরেক ছেলে দীপু বর্মণ প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে তাঁদের পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি। টিকা নেওয়ার প্রস্তুতির মাঝেই তাঁর বাবা অসুস্থ হয়েছেন।

মুগদা হাসপাতালের আটতলার ২৩৯ নম্বর কক্ষের আটটি শয্যার প্রতিটিতে করোনা রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে ৪ জনের বয়স ৩০ বছরের নিচে। বাকি চারজন ষাটোর্ধ্ব।

মুগদা হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ প্রথম আলোকে বলেন, এক সপ্তাহ ধরে ১৪টি আইসিইউ শয্যার প্রতিটিতে সার্বক্ষণিক রোগী থাকছেন।

আইসিইউর সংকট কাটছে না

করোনায় সংক্রমিত জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্তদের ৪০ শতাংশের উপসর্গ থাকে মৃদু। মাঝারি মাত্রার উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশের। তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে। তীব্র উপসর্গ ও জটিল রোগীদের প্রায় সবার এবং মাঝারি উপসর্গ রয়েছে, এমন অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জটিল প্রায় সব রোগীর আইসিইউ শয্যার পাশাপাশি ভেন্টিলেটর দরকার হয়।

ঢাকায় করোনার জন্য নির্ধারিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোনো আইসিইউ শয্যাই গতকাল ফাঁকা ছিল না। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি শয্যার ১২টিতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি আইসিইউ শয্যার ১৩টিতে, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ১৬টি আইসিইউর ১০টিতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪ শয্যার মধ্যে ১৭টিতে রোগী ভর্তি ছিলেন। আইসিইউ শয্যা বেশি ফাঁকা ছিল মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে, সেখানে ১৬টি শয্যার ৩টিতে রোগী ভর্তি ছিলেন।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউ শয্যা ফাঁকা থাকছে না, সাধারণ শয্যাতেও রোগী ভর্তি থাকছেন। দেশে আবার করোনা রোগী বাড়তে
শুরু করেছে, এটি তারই ইঙ্গিত। রোগী বাড়তে থাকলে করোনার জন্য নির্ধারিত যেসব হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আবার দ্রুত চালু করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *