বিয়েবাড়ি। বড় বড় হাঁড়ি, কড়াইয়ে রান্না চাপানো হয়েছে। বড় হাতা নিয়ে মাংস নাড়ছেন রাঁধুনি। বিয়েবাড়িতে এমন আয়োজন সবারই চোখে পড়বে। বিয়ের আসরে শত শত মানুষের জন্য ভালো রান্নার ভার যাঁর কাঁধে থাকে, তাঁকে হতে হয় চৌকস। এমনই একজন রাঁধুনি জামালপুরের মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি শখের রাঁধুনি। শিক্ষকতা করতেন। এখন অবসরে। যেকোনো অনুষ্ঠানে যান স্যুট-বুট পরে। এরপর কাপড় পাল্টে নেমে যান রান্নার কাজে। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রান্না শুরু করেছিলেন। এমনকি নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানের রান্নাও নিজেই করেছিলেন তিনি। এখনো বিনা পারিশ্রমিকেই করে যাচ্ছেন তাঁর এ ভালোবাসার কাজ।
মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন পরিচিত তোহা নামেও। শিক্ষক হিসেবে পরিচয়ের পাশাপাশি তাঁর রান্নার সুনামও জামালপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৭৩ সাল থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রান্না করেন তিনি। রান্নার সময় হিন্দু বা মুসলমানের ভেদাভেদ করেন না তিনি। এ পর্যন্ত বিনা পারিশ্রমিকে হিন্দু পরিবারের বিয়েসহ বহু অনুষ্ঠানে রান্না করেছেন। শখে রান্না করলেও রান্নাটাকে তিনি শিল্প এবং রান্নার মধ্য দিয়েই তিনি জনসেবা করছেন বলে মনে করেন।

জামালপুর সদরের নরুন্দি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৯৮৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোয়াজ্জেম হোসেন শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৬ সালে নিজের বিয়ে, পরে দুই ছেলেমেয়ের বিয়ের রান্নাও নিজেই করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন। জামালপুরে সম্প্রতি একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে রান্না করতে গিয়েছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন, ‘আমার বিয়ের সময় সবাই বলল, তুই ছাড়া কে আর রান্না করবে? খাসির কোর্মা, গরুর রেজালা, মুরগির রোস্ট রান্না করলাম। দই নিজেই বানাই। বউয়ের বাপের বাড়ির লোকজন রান্না খেয়ে মহা খুশি। তাঁরা তো আর আগে জানতেন না মেয়ের জামাই রান্নাও পারে।’
১৯৭৩ সালে রান্নার শুরু সম্পর্কে মোয়াজ্জেম হোসেন জানালেন, ‘শাহ মোহাম্মদ মোদক নামে পরিচিত একজনের বিয়েতে বাবুর্চির আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে বাবুর্চি না আসায় সবাই বিপাকে পড়ে যান। তখন তিনি রান্না করবেন বলে নিজেই জানিয়েছিলেন। সেই শুরু। বর্তমানে ৬৬ বছর বয়সেও থেমে নেই রান্নার কাজ।’
মোয়াজ্জেম হোসেনের মেয়ে মাহবুবা আক্তার বললেন, ‘বাবাকে ১ হাজার ২০০ মানুষের রান্নার লিস্ট দেখিয়ে নিলেন। বাজারের লিস্ট করা থেকে শুরু করে সবই বাবা নিজে তদারক করেন। বাবা যে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, সেই স্কুলেই আমি পড়েছি।
বাবার রান্নার প্রশংসা করতেন সবাই। বাবার রান্নার কাজ ভালো লাগে। তবে বয়স হওয়ার কারণে রান্না করতে গেলেই অসুস্থ হয়ে যান। কয়েক দিন আগেও সেন্সলেস হয়ে যান। তাই আমরা এখন আপত্তি করি।’

মোয়াজ্জেম হোসেনের একটি ব্যাগ তৈরিই থাকে। ব্যাগে রোস্ট ভাজার জন্য ঝাঁঝরি, পানি ও তেল মাপার জন্য একটি গ্লাস, খাবার নাড়া দেওয়ার জন্য বড় একটি হাতা নিয়ে যান। নিজেই এগুলো বানিয়ে নিয়েছেন। রান্নার জন্য গেলে সারা দিনের জন্য যেতে হয়। রান্না শেষে খাবার বেড়ে দেওয়ার দায়িত্বও পালন করতে হয়। খাবার কম পড়ল কি না, তা দেখার জন্য সবার খাওয়া শেষ হলে ছুটি পান তিনি।
স্ত্রী হোসনে আরা বেগম ভালো রান্না করেন, তাই বাড়ির রান্নাঘরে তেমন একটা ঢুকতে হয় না মোয়াজ্জেম হোসেনকে। ছেলেমেয়েরা রান্নার বিষয়টিতে তেমন উৎসাহী নন। তবে ছেলের বউয়ের রান্না ভালো বলে জানালেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
মোয়াজ্জেম হোসেন এখনো একাই চার মণ, পাঁচ মণ মাংস রান্না করে ফেলেন। রান্নায় সহকারী থাকে, তবে অন্যদের চেয়ে নিজে কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। জানালেন, গ্রামাঞ্চলের বিয়েতে সাধারণত গরুর মাংস, পোলাও, কোর্মা, জর্দা, মুরগির রোস্ট, মুরগির কোর্মা বেশি রান্না হয়।
রান্নার পাশাপাশি খেলাধুলা করতেন মোয়াজ্জেম হোসেন। সভা-সমিতি, মসজিদের সেবা,আচার–অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াসহ দিনের বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়। সন্ধ্যার পরে গান গাইতে পছন্দ করেন, তবে সুর-তাল-লয় নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করেন না। এসবের পাশাপাশি বাংলা, বিহার ও ওডিশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাটকের ডায়ালগসহ বিভিন্ন নাটকের ডায়ালগ মুখস্থ। চাচার পরিচালিত নাটকসহ পাঁচ থেকে ছয়টি নাটকে অভিনয়ও করেছেন তিনি।

মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন, ‘রান্নাটা একটা শিল্প। জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাতে সবারই রান্নাটা শেখা দরকার। কিন্তু সেভাবে কেউ এগিয়ে আসে না। নিজের ছেলেমেয়েদেরও এ বিষয়ে উৎসাহী করতে পারলাম না। গ্রামের বিয়েতে শহর থেকে বাবুর্চি আনতে হলে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা লাগে। কোনো কোনো পরিবারের জন্য এ টাকা ব্যয় করা কঠিন হয়ে যায়। দরিদ্র পরিবারে কারও বিয়ের কথা শুনলে রান্নার কাজটা নিজের আগ্রহেই করি। রান্না করে টাকা নিলে জীবনে বহুত টাকা কামাইতে পারতাম। তা করি নাই। এটাকেই আমি মানবসেবা মনে করি।’
এ পর্যন্ত রান্না করতে গিয়ে একবারই রান্না নষ্ট হয়েছিল বলে জানালেন মোয়াজ্জেম হোসেন। বললেন, আগে বড় কড়াইয়ে রান্নার চল ছিল। রান্না শেষে কড়াইয়ের হাতলের মধ্যে বাঁশ ঢুকিয়ে কড়াই চুলা থেকে নামাতে হতো। রান্নার শেষ পর্যায়ে হুট করে তুমুল বৃষ্টি নামে। বাঁশ আনতে আনতে রান্নাটাই নষ্ট হয়ে যায়।
রান্না ভালো হয়েছে, এ প্রশংসাবাণী বেশি শুনেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন। বললেন, ‘রান্না ভালো হলে আমিও মনে তৃপ্তি পাই। একেকটা অনুষ্ঠানে ৩০০–৫০০ জন মানুষ খায়। ব্যতিক্রম তো থাকেই। কারও কাছে হয়তো রান্নাটা ভালো লাগে না। তবে গড়ে রান্নাটা ভালো হয়েছে বলেই বেশির ভাগ মানুষ জানান।’