নেতৃত্বের ‘দ্বন্দ্ব’ থেকে সহিংসতা

নেতৃত্বের ‘দ্বন্দ্ব’ থেকে সহিংসতা

তে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত বেধেছে এবং পুনরায় সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনার কারণে স্থগিত হওয়া সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৭ জানুয়ারি।

দলীয় নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্রোহের মূলে রয়েছে নগর আওয়ামী লীগের পুরোনো বিরোধ। একটি পক্ষে সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং অপর পক্ষে রয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। মহিবুল সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে। এবার দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছেন মহিবুলের অনুসারীরা। ফলে নাখোশ হন নাছিরপন্থীরা।

পাঠানটুলী ওয়ার্ডেও দলীয় মনোনয়ন পান মহিবুলের পক্ষের নজরুল ইসলাম বাহাদুর। নাছিরের অনুসারী সদ্য সাবেক কাউন্সিলর আবদুল কাদের বিদ্রোহী প্রার্থী হন সেখানে। দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনার পর তা গড়ায় সংঘাতে। পাঠানটুলীর ঘটনায় নিহত আজগরের ছেলে সেজান মাহমুদের বাদী হয়ে করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রার্থী কাদেরসহ ১৩ জন। তাঁদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর আগে প্রথম দফা প্রচারণার সময় গত বছরের ১৮ মার্চ দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে দুই প্রার্থীর রেষারেষিতে জাহিদ তানভির নামের এক যুবক খুন হন। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. ইসমাইল হোসেন উপমন্ত্রী মহিবুলের অনুসারী। বিদ্রোহী হয়েছেন সদ্য সাবেক কাউন্সিলর নাছিরপন্থী মোরশেদ আকতার চৌধুরী। জাহিদ তানভির সাবেক কাউন্সিলর মোরশেদ আকতারের সমর্থক বলে পরিচিত ছিলেন।

আজগর আলী বাবুল

আজগর আলী বাবুল
ছবি: সংগৃহীত

মঙ্গলবারের খুনের ঘটনার পর গতকাল বুধবার রাতে জরুরি বৈঠকে করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাংসদ মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্রোহীদের পেছনে কারও কারও ইন্ধন থাকতে পারে। কিন্তু এটা তাঁরা ভুল করছেন। ইন্ধনদাতা অভিভাবকদের উচিত বিদ্রোহীদের দু–তিন দিনের মধ্যে প্রচারণা বন্ধ করে দিতে বাধ্য করা।

বিরোধ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে বিদ্রোহের নাম দিয়ে খুনি–সন্ত্রাসীর মাধ্যমে হত্যার রাজনীতি চালু করা হচ্ছে। আমার গ্রুপ বা সাবেক মেয়রের (নাছির) গ্রুপ—যে–ই হোক না কেন, যাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁরা সবাই স্বচ্ছ ভাবমূর্তির।’

আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগের একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও সহিংসতা নিয়ে নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ প্রশাসনও ভাবনায় রয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে কয়েক দিন আগে একটি প্রতিবেদনও সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বিরোধপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর দিকে নজর রেখেছে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ও।

বাবুল হত্যার নেপথ্যে

নজরুল ইসলাম বাহাদুরের পক্ষ নেওয়ার কারণে বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরের সঙ্গে আজগর আলী ওরফে বাবুলের বিরোধ শুরু হয়। এর আগেরবারের নির্বাচনে মহল্লা সরদার আজগর ছিলেন কাদেরের পক্ষে। তখন কাদের বাহাদুরকে হারিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গতকাল দুপুরে নিহত আজগরের পাঠানটুলী ওয়ার্ডের কাটা বটতল এলাকার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন মেয়ে মিথিলা ও আজগরের মা জোছনা বেগম।

মা জোছনা বেগম বলেন, ‘আমি কাদেরকে ছাড়ব না। তাঁর ফাঁসি চাই। বাহাদুরের পক্ষে এবার আমার ছেলে যাওয়ায় কাদের হুমকি দিয়েছিল।’

এলাকাবাসী জানান, সরদার হওয়ায় আজগরের প্রভাব রয়েছে এলাকায়। এ জন্য কাদের তাঁর ওপর খেপেছেন। এ ছাড়া কাদেরের এবার প্রতীক ছিল ব্যাডমিন্টন। গত মঙ্গলবার সকালে ব্যাডমিন্টন আকৃতির কিছু লোহার র‍্যাকেটসদৃশ অস্ত্র বানানোর সময় বাবুল তা ধরিয়ে দেন। এটাও বাবুলের ওপর কাদেরের ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ। এ ছাড়া বাহাদুরের পক্ষ নিয়ে বাবুল নিজের ফেসবুক পেজে ‘মাছ কাদের’–এর নাম উল্লেখ করে কয়েকটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন এক সপ্তাহ ধরে। সাবেক কাউন্সিলর আবদুল কাদের ‘মাছ কাদের’ নামে পরিচিত।

আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, ‘নির্বাচনে আমার পক্ষে আসার কারণে তাঁর (বাবুল) ওপর ক্ষিপ্ত হয় কাদের। সে কারণে বাবুলকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয় বলে মনে করি।’

আজগর হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরসহ (হেলমেট পরা) ১৩ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। বুধবার বিকেলে চট্টগ্রাম আদালত ভবনে।

আজগর হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরসহ (হেলমেট পরা) ১৩ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। বুধবার বিকেলে চট্টগ্রাম আদালত ভবনে।
ছবি: প্রথম আলো

সিসি ক্যামেরা বন্ধ

পাঠানটুলী ওয়ার্ডের মগপুকুর পাড় এলাকাটি কাদেরের আস্তানা হিসেবে পরিচিত। মঙ্গলবার রাতে সেখানে বাহাদুর তাঁর সমর্থকদের নিয়ে প্রচারণায় যান। এ সময় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
ডবলমুরিং থানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনাস্থল ও আশপাশে সাতটি সিসি ক্যামেরা ছিল। কিন্তু সেগুলো ভাঙা পাওয়া গেছে। কোনো রেকর্ডও পাওয়া যায়নি। ঘটনা পরিকল্পিত নাকি তাৎক্ষণিকভাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

নগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

দুই পক্ষে গোলাগুলি হয়েছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় মাহবুব নামের একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মিন্টু নামের একজন চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁর মাথা ফেটে যায়। তিনি কাদেরের অনুসারী। অলি নামের অপর একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি রয়েছেন। অলি নিজেকে পথচারী দাবি করেছেন।

জানাজায় ছিলেন না মাহাতাব-নাছির

গতকাল বিকেল সাড়ে চারটায় আগ্রাবাদ কমার্স কলেজের সামনে রাস্তায় আজগরের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনানসহ নেতা–কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ছিলেন না দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।

জানাজায় নিহতের বড় ছেলে সেজান মাহমুদ বলেন, ‘আবদুল কাদের, হেলাল, রিপনেরা আমার বাবাকে হত্যা করেছে। আমি তাদের শাস্তি চাই।’

নির্বাচনে এমন সহিংসতা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য শুভ নয় বলে মন্তব্য করেছেন সচেতন নাগরিক কমিটি চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন বড় দলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। মনোনয়ন না পেলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হন বেশি। কারণ, তাঁরা জানেন, হয়তো এমন হলে প্রশাসনের আনুকূল্য পাবেন। আর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলা হলেও তা মূলত দৃশ্যমান হয় না। এ জন্য তাঁরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন, সহিংসতায় লিপ্ত হন। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্ত হতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *